ঢাকা ০৭:৪৭ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আশ্বাসেই ঘুরপাক খাচ্ছে রোহিঙ্গা ইস্যু

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১০:৩৮:৩৫ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৬ অক্টোবর ২০১৭
  • ২৯৭ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ নির্যাতনের মুখে প্রাণ বাঁচাতে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে আবারও আশ্বাস দিয়েছে দেশটি। মিয়ানমার সফররত বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে প্রথমে সে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পরে স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চির সঙ্গে পৃথক বৈঠকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে এমন সম্মতি জানানো হয়। অবশ্য আরো এক ধাপ এগিয়ে সু চি বলেছেন, তার সরকার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে কাজ করছে। এ নিয়ে এ মাসেই দুই দেশের মধ্যে দুই দফা বৈঠক হলো। এর আগে গত ২ অক্টোবর ঢাকায় সু চির দফতরবিষয়ক মন্ত্রীর সঙ্গে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এক বৈঠকে অনুরূপ আশ্বাস দিয়েছিল দেশটি। সে বৈঠকে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে ‘জয়েন্ট ওয়ার্কিং কমিটি’ গঠনেরও সিদ্ধান্ত হয়। এমনকি রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে দ্বিপক্ষীয় চুক্তির খসড়া হস্তান্তর করা হয়।

প্রথম দফা বৈঠকের তিন সপ্তাহ পর গত মঙ্গল ও গতকাল বুধবার দ্বিতীয় দফায় এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হলো। দুই বৈঠকের মাঝখানের ২৩ দিনে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে মিয়ানমার কোনো উদ্যোগ নেয়নি। উল্টো আন্তর্জাতিক চাপ উপেক্ষা করে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন অব্যাহত রেখেছে। সে নির্যাতন এখনো চলছে। প্রতিদিনই বাংলাদেশে পালিয়ে আসছে রোহিঙ্গারা। ভিড় জমাচ্ছে বাংলাদেশ সীমান্তে।

সর্বশেষ গত ১২ অক্টোবর অং সান সু চি ও সে দেশের সেনাপ্রধান রোহিঙ্গা ইস্যুতে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিয়েছেন। সেদিন জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে সু চি বলেন, রাখাইন থেকে পালিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে আনতে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা চলছে। অথচ সেদিনই মিয়ানমারে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত স্কট মার্সিয়েলের সঙ্গে বৈঠক শেষে সেনাপ্রধান তার ফেসবুকে বলেন, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের বাসিন্দা নয়। রোহিঙ্গা মুসলিমরা মিয়ানমারের জনগোষ্ঠী নয়। আর দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সংখ্যা গণমাধ্যমে অতিরঞ্জিত করে প্রকাশ করা হয়েছে। এমনকি সেনাপ্রধান রোহিঙ্গাদের ‘বাঙালি’ বলেও মন্তব্য করেছেন। এর আগে গত ১৬ সেপ্টেম্বরও অনুরূপভাবে ‘রোহিঙ্গারা স্বীকৃতি দাবি করছে অথচ তারা কখনো মিয়ানমারের নৃগোষ্ঠী ছিল না। এটি ‘বাঙালি ইস্যু’ বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

এমন পরিস্থিতিতে মিয়ানমারের দ্বিতীয় দফার আশ্বাসেও আশ্বস্ত হতে পারছে না বাংলাদেশ। আদৌ মিয়ানমার সরকার পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে চায় কি না এবং রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে সদিচ্ছাইবা কতটুকু; নাকি বারবার আলোচনা ও আশ্বাসের নামে সময়ক্ষেপণ ও আন্তর্জাতিক চাপ প্রশমনের কৌশল নিয়েছে দেশটি—এ নিয়ে বারবার দেখা দিচ্ছে সন্দেহ। নানা প্রশ্ন উঠছে নানা মহলে। বিশেষ করে দুই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মঙ্গলবারের বৈঠকে উঠে আসা কিছু মতানৈক্য মিয়ানমারের দ্বিতীয় দফা সদিচ্ছা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ৩০ নভেম্বরের মধ্যে জয়েন্ট ওয়ার্কিং কমিটি গঠনের প্রস্তাব দিলেও মিয়ানমার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ ব্যাপারে কোনো দিনক্ষণ উল্লেখ করেননি। দুই দেশের সমানসংখ্যক প্রতিনিধি নিয়ে এ কমিটি গঠন হবে বলা হলেও প্রতিনিধিদের মধ্যে কারা থাকবেন, সে ব্যাপারে কিছু বলেনি মিয়ানমার। মতবিরোধ দেখা দিয়েছে কফি আনান কমিশন রিপোর্ট বাস্তবায়ন নিয়েও। একদিকে বৈঠকে মিয়ানমার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, কমিশন রিপোর্ট বাস্তবায়নে তার সরকার কয়েকটি কমিটি গঠন করেছে। কিন্তু বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জয়েন্ট ওয়ার্কিং কমিটিকে দিয়ে কমিশন রিপোর্ট বাস্তবায়নের প্রস্তাব রেখেছেন। এ ব্যাপারে মিয়ানমারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কিছু বলেননি। আসাদুজ্জামান খান রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন বন্ধের দাবি জানালে মিয়ানমারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লেফটেন্যান্ট কর্নেল চ সুয়ি অস্বীকার করে বলেছেন, কোনো নির্যাতন হচ্ছে না, তারা (রোহিঙ্গারা) নিজেরাই চলে যাচ্ছে। আসাদুজ্জামান খান রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি স্বচক্ষে দেখতে রাখাইনে যেতে চাইলে তাতে ইতিবাচক সাড়া পাননি। এমনকি সীমান্তে মাইন পুঁতে রাখার বিষয়টি অস্বীকার করে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ অন্যদের দোষারোপ করেছে।

এমন পরিপ্রেক্ষিতে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বাংলাদেশকে ধৈর্য নিয়ে কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, মিয়ানমার কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে। তারা সময়ক্ষেপণ করে পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত করার চেষ্টা করছে। এরই মধ্যে তাদের ওপর অব্যাহত আন্তর্জাতিক চাপ প্রশমনের কৌশলও নিয়েছে। সুতরাং মিয়ানমারের আশ্বাসে চুপ করে না থেকে দেশটির ওপর আন্তর্জাতিক চাপ যাতে অব্যাহত থাকে, বাংলাদেশকে সে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। পাশাপাশি দ্বিপক্ষীয় কূটনীতির মাধ্যমে সমস্যা সমাধানে মিয়ানমারকে সম্মত করাতে হবে।

বাংলাদেশও ধৈর্যসহকারে সংকট সমাধানের পক্ষে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত সোমবারও মন্ত্রিসভার বৈঠকে বলেছেন, বাড়াবাড়ি বা ঝগড়াঝাটি করে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। ধৈর্য ধরে কূটনৈতিক তৎপরতা ও আলোচনার মাধ্যমে এ সংকটের সমাধান করতে হবে। এজন্য মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত রাখতে বাংলাদেশ কাজ করে যাবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। একইভাবে বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় আশ্রয় নেওয়া বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নাগরিকদের নিয়ে সৃষ্ট সংকট সমাধানের বিষয়টির অগ্রগতি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে বৈঠকে মিয়ানমার জানিয়েছে, রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনে কাজ শুরু করেছে দেশটি। এর বাস্তবায়ন কীভাবে হবে সেসবের জন্য আলোচনা করতে হবে বাংলাদেশকে। কারণ রোহিঙ্গাদেরকে ফেরত পাঠাতে হলে মিয়ানমারের সঙ্গেও আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে। একই সঙ্গে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে নিরাপদ ও টেকসই পরিবেশ সৃষ্টি করার দাবিও জানাতে হবে।

এদিকে মুখে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার কথা বললেও এবং সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক চাপের মুখেও মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নির্যাতন বন্ধ হয়নি বলে দেশি-বিদেশি কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে। এখনো বাংলাদেশে আসছে রোহিঙ্গারা। গত দুই মাসে নতুন করে এসেছে ছয় লাখের বেশি। ফলে নতুন পুরাতন মিলে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গার সর্বমোট সংখ্যা ১০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। নির্যাতন শুরুর পর গত দুই মাসে বাংলাদেশের জোরালো কূটনৈতিক তৎপরতার ফলে সংকট সমাধানে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ ক্রমেই বাড়ছে। সর্বশেষ যুক্তরাষ্ট্র দেশটির ওপর নানা ধরনের বিধিনিষেধ আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর আগে রোহিঙ্গা নিধনের পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) মিয়ানমারের ব্যাপারে এরই মধ্যে ব্যবস্থা নেয়। যুক্তরাজ্য মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে দেওয়া সব ধরনের প্রশিক্ষণ সহযোগিতা স্থগিত করেছে। আর জোটবদ্ধ হিসেবে ইইউ মিয়ানমারের জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তাদের ইউরোপে আমন্ত্রণ জানানো স্থগিত এবং প্রতিরক্ষা সম্পর্ক পুনর্বিবেচনা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

অবশ্য সংশ্লিষ্ট কূটনীতিকরা মিয়ানমারের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের মাধ্যমেই সম্মিলিতভাবে ব্যবস্থা নেওয়ার ওপর জোর দিচ্ছে। তাদের আশঙ্কা, যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ বা পশ্চিমা দেশগুলো মিয়ানমারের ওপর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিলে ওই দেশটিতে চীন ও অন্য মিত্রদের প্রভাব আরো পাকাপোক্ত করার সুযোগ সৃষ্টি করবে।

এ ব্যাপারে মিয়ানমারে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর (অব.) ইমদাদুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ এ মুহূর্তে কূটনৈতিকভাবে সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। সারা পৃথিবীর জনমত আমাদের পক্ষে। বৈশ্বিক এ অবস্থানকে কূটনৈতিক দক্ষতায় বাংলাদেশকে কাজে লাগাতে হবে। আমরা দ্বিপক্ষীয় কূটনীতি চালাব। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে, এ আলোচনাকে কেন্দ্র করে মিয়ানমার যেন কোনো কৌশল নিতে না পারে। পৃথিবীর কোনো আইন দিয়ে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিকত্বকে অস্বীকার করতে পারবে না দেশটি। তাই আমাদের শক্ত অবস্থানে থাকতে হবে।

এর আগেও মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার ব্যাপারে বিশেষ কৌশল নিয়েছে-উল্লেখ করে বিশ্লেষকরা জানান, ১৯৯২ সালের ২৩-২৮ এপ্রিল পর্যন্ত দ্বিপক্ষীয় আলোচনা হয় এবং আলোচনা শেষে মিয়ানমার ও বাংলাদেশ একটি যৌথ ঘোষণার মাধ্যমে ১৯৯২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর থেকে ২০০৫ সালের ২৮ জুলাই পর্যন্ত দুই লাখ ৩৬ হাজার ৫৯৯ রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে সক্ষম হয়। কিন্তু ২০০৫ সালের মিয়ানমার আর ২০১৭ সালের মিয়ানমারের পরিস্থিতি ভিন্ন। এরই মধ্যে সুকৌশলে রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গাদের আরো প্রান্তিক করে ফেলা হয়েছে। রোহিঙ্গারা যে নিজেদের মিয়ানমারের স্থায়ী বা অস্থায়ী বাসিন্দা বলে প্রমাণ করবে তার কাগজপত্র রীতিমতো গায়েব করে ফেলা হয়েছে। ১৯৮২ সালের মিয়ানমার নাগরিকত্ব আইন দিয়ে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হয়। তার পরই ১৯৯২ সালে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে সমঝোতা হয়, যেখানে রোহিঙ্গাদের রাখাইনের অধিবাসী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। অথচ ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের যে সমঝোতা হয়েছিল, সে অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের সে দেশের নাগরিক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ফলে মিয়ানমার অনেক হিসাব-নিকাশ করেই ১৯৭৮ সালের ফর্মুলা না এনে, ১৯৯২ সালের ফর্মুলার কথা বলছে।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

আশ্বাসেই ঘুরপাক খাচ্ছে রোহিঙ্গা ইস্যু

আপডেট টাইম : ১০:৩৮:৩৫ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৬ অক্টোবর ২০১৭

হাওর বার্তা ডেস্কঃ নির্যাতনের মুখে প্রাণ বাঁচাতে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে আবারও আশ্বাস দিয়েছে দেশটি। মিয়ানমার সফররত বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে প্রথমে সে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পরে স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চির সঙ্গে পৃথক বৈঠকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে এমন সম্মতি জানানো হয়। অবশ্য আরো এক ধাপ এগিয়ে সু চি বলেছেন, তার সরকার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে কাজ করছে। এ নিয়ে এ মাসেই দুই দেশের মধ্যে দুই দফা বৈঠক হলো। এর আগে গত ২ অক্টোবর ঢাকায় সু চির দফতরবিষয়ক মন্ত্রীর সঙ্গে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এক বৈঠকে অনুরূপ আশ্বাস দিয়েছিল দেশটি। সে বৈঠকে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে ‘জয়েন্ট ওয়ার্কিং কমিটি’ গঠনেরও সিদ্ধান্ত হয়। এমনকি রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে দ্বিপক্ষীয় চুক্তির খসড়া হস্তান্তর করা হয়।

প্রথম দফা বৈঠকের তিন সপ্তাহ পর গত মঙ্গল ও গতকাল বুধবার দ্বিতীয় দফায় এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হলো। দুই বৈঠকের মাঝখানের ২৩ দিনে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে মিয়ানমার কোনো উদ্যোগ নেয়নি। উল্টো আন্তর্জাতিক চাপ উপেক্ষা করে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন অব্যাহত রেখেছে। সে নির্যাতন এখনো চলছে। প্রতিদিনই বাংলাদেশে পালিয়ে আসছে রোহিঙ্গারা। ভিড় জমাচ্ছে বাংলাদেশ সীমান্তে।

সর্বশেষ গত ১২ অক্টোবর অং সান সু চি ও সে দেশের সেনাপ্রধান রোহিঙ্গা ইস্যুতে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিয়েছেন। সেদিন জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে সু চি বলেন, রাখাইন থেকে পালিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে আনতে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা চলছে। অথচ সেদিনই মিয়ানমারে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত স্কট মার্সিয়েলের সঙ্গে বৈঠক শেষে সেনাপ্রধান তার ফেসবুকে বলেন, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের বাসিন্দা নয়। রোহিঙ্গা মুসলিমরা মিয়ানমারের জনগোষ্ঠী নয়। আর দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সংখ্যা গণমাধ্যমে অতিরঞ্জিত করে প্রকাশ করা হয়েছে। এমনকি সেনাপ্রধান রোহিঙ্গাদের ‘বাঙালি’ বলেও মন্তব্য করেছেন। এর আগে গত ১৬ সেপ্টেম্বরও অনুরূপভাবে ‘রোহিঙ্গারা স্বীকৃতি দাবি করছে অথচ তারা কখনো মিয়ানমারের নৃগোষ্ঠী ছিল না। এটি ‘বাঙালি ইস্যু’ বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

এমন পরিস্থিতিতে মিয়ানমারের দ্বিতীয় দফার আশ্বাসেও আশ্বস্ত হতে পারছে না বাংলাদেশ। আদৌ মিয়ানমার সরকার পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে চায় কি না এবং রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে সদিচ্ছাইবা কতটুকু; নাকি বারবার আলোচনা ও আশ্বাসের নামে সময়ক্ষেপণ ও আন্তর্জাতিক চাপ প্রশমনের কৌশল নিয়েছে দেশটি—এ নিয়ে বারবার দেখা দিচ্ছে সন্দেহ। নানা প্রশ্ন উঠছে নানা মহলে। বিশেষ করে দুই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মঙ্গলবারের বৈঠকে উঠে আসা কিছু মতানৈক্য মিয়ানমারের দ্বিতীয় দফা সদিচ্ছা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ৩০ নভেম্বরের মধ্যে জয়েন্ট ওয়ার্কিং কমিটি গঠনের প্রস্তাব দিলেও মিয়ানমার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ ব্যাপারে কোনো দিনক্ষণ উল্লেখ করেননি। দুই দেশের সমানসংখ্যক প্রতিনিধি নিয়ে এ কমিটি গঠন হবে বলা হলেও প্রতিনিধিদের মধ্যে কারা থাকবেন, সে ব্যাপারে কিছু বলেনি মিয়ানমার। মতবিরোধ দেখা দিয়েছে কফি আনান কমিশন রিপোর্ট বাস্তবায়ন নিয়েও। একদিকে বৈঠকে মিয়ানমার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, কমিশন রিপোর্ট বাস্তবায়নে তার সরকার কয়েকটি কমিটি গঠন করেছে। কিন্তু বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জয়েন্ট ওয়ার্কিং কমিটিকে দিয়ে কমিশন রিপোর্ট বাস্তবায়নের প্রস্তাব রেখেছেন। এ ব্যাপারে মিয়ানমারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কিছু বলেননি। আসাদুজ্জামান খান রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন বন্ধের দাবি জানালে মিয়ানমারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লেফটেন্যান্ট কর্নেল চ সুয়ি অস্বীকার করে বলেছেন, কোনো নির্যাতন হচ্ছে না, তারা (রোহিঙ্গারা) নিজেরাই চলে যাচ্ছে। আসাদুজ্জামান খান রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি স্বচক্ষে দেখতে রাখাইনে যেতে চাইলে তাতে ইতিবাচক সাড়া পাননি। এমনকি সীমান্তে মাইন পুঁতে রাখার বিষয়টি অস্বীকার করে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ অন্যদের দোষারোপ করেছে।

এমন পরিপ্রেক্ষিতে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বাংলাদেশকে ধৈর্য নিয়ে কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, মিয়ানমার কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে। তারা সময়ক্ষেপণ করে পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত করার চেষ্টা করছে। এরই মধ্যে তাদের ওপর অব্যাহত আন্তর্জাতিক চাপ প্রশমনের কৌশলও নিয়েছে। সুতরাং মিয়ানমারের আশ্বাসে চুপ করে না থেকে দেশটির ওপর আন্তর্জাতিক চাপ যাতে অব্যাহত থাকে, বাংলাদেশকে সে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। পাশাপাশি দ্বিপক্ষীয় কূটনীতির মাধ্যমে সমস্যা সমাধানে মিয়ানমারকে সম্মত করাতে হবে।

বাংলাদেশও ধৈর্যসহকারে সংকট সমাধানের পক্ষে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত সোমবারও মন্ত্রিসভার বৈঠকে বলেছেন, বাড়াবাড়ি বা ঝগড়াঝাটি করে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। ধৈর্য ধরে কূটনৈতিক তৎপরতা ও আলোচনার মাধ্যমে এ সংকটের সমাধান করতে হবে। এজন্য মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত রাখতে বাংলাদেশ কাজ করে যাবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। একইভাবে বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় আশ্রয় নেওয়া বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নাগরিকদের নিয়ে সৃষ্ট সংকট সমাধানের বিষয়টির অগ্রগতি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে বৈঠকে মিয়ানমার জানিয়েছে, রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনে কাজ শুরু করেছে দেশটি। এর বাস্তবায়ন কীভাবে হবে সেসবের জন্য আলোচনা করতে হবে বাংলাদেশকে। কারণ রোহিঙ্গাদেরকে ফেরত পাঠাতে হলে মিয়ানমারের সঙ্গেও আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে। একই সঙ্গে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে নিরাপদ ও টেকসই পরিবেশ সৃষ্টি করার দাবিও জানাতে হবে।

এদিকে মুখে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার কথা বললেও এবং সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক চাপের মুখেও মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নির্যাতন বন্ধ হয়নি বলে দেশি-বিদেশি কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে। এখনো বাংলাদেশে আসছে রোহিঙ্গারা। গত দুই মাসে নতুন করে এসেছে ছয় লাখের বেশি। ফলে নতুন পুরাতন মিলে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গার সর্বমোট সংখ্যা ১০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। নির্যাতন শুরুর পর গত দুই মাসে বাংলাদেশের জোরালো কূটনৈতিক তৎপরতার ফলে সংকট সমাধানে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ ক্রমেই বাড়ছে। সর্বশেষ যুক্তরাষ্ট্র দেশটির ওপর নানা ধরনের বিধিনিষেধ আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর আগে রোহিঙ্গা নিধনের পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) মিয়ানমারের ব্যাপারে এরই মধ্যে ব্যবস্থা নেয়। যুক্তরাজ্য মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে দেওয়া সব ধরনের প্রশিক্ষণ সহযোগিতা স্থগিত করেছে। আর জোটবদ্ধ হিসেবে ইইউ মিয়ানমারের জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তাদের ইউরোপে আমন্ত্রণ জানানো স্থগিত এবং প্রতিরক্ষা সম্পর্ক পুনর্বিবেচনা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

অবশ্য সংশ্লিষ্ট কূটনীতিকরা মিয়ানমারের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের মাধ্যমেই সম্মিলিতভাবে ব্যবস্থা নেওয়ার ওপর জোর দিচ্ছে। তাদের আশঙ্কা, যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ বা পশ্চিমা দেশগুলো মিয়ানমারের ওপর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিলে ওই দেশটিতে চীন ও অন্য মিত্রদের প্রভাব আরো পাকাপোক্ত করার সুযোগ সৃষ্টি করবে।

এ ব্যাপারে মিয়ানমারে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর (অব.) ইমদাদুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ এ মুহূর্তে কূটনৈতিকভাবে সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। সারা পৃথিবীর জনমত আমাদের পক্ষে। বৈশ্বিক এ অবস্থানকে কূটনৈতিক দক্ষতায় বাংলাদেশকে কাজে লাগাতে হবে। আমরা দ্বিপক্ষীয় কূটনীতি চালাব। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে, এ আলোচনাকে কেন্দ্র করে মিয়ানমার যেন কোনো কৌশল নিতে না পারে। পৃথিবীর কোনো আইন দিয়ে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিকত্বকে অস্বীকার করতে পারবে না দেশটি। তাই আমাদের শক্ত অবস্থানে থাকতে হবে।

এর আগেও মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার ব্যাপারে বিশেষ কৌশল নিয়েছে-উল্লেখ করে বিশ্লেষকরা জানান, ১৯৯২ সালের ২৩-২৮ এপ্রিল পর্যন্ত দ্বিপক্ষীয় আলোচনা হয় এবং আলোচনা শেষে মিয়ানমার ও বাংলাদেশ একটি যৌথ ঘোষণার মাধ্যমে ১৯৯২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর থেকে ২০০৫ সালের ২৮ জুলাই পর্যন্ত দুই লাখ ৩৬ হাজার ৫৯৯ রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে সক্ষম হয়। কিন্তু ২০০৫ সালের মিয়ানমার আর ২০১৭ সালের মিয়ানমারের পরিস্থিতি ভিন্ন। এরই মধ্যে সুকৌশলে রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গাদের আরো প্রান্তিক করে ফেলা হয়েছে। রোহিঙ্গারা যে নিজেদের মিয়ানমারের স্থায়ী বা অস্থায়ী বাসিন্দা বলে প্রমাণ করবে তার কাগজপত্র রীতিমতো গায়েব করে ফেলা হয়েছে। ১৯৮২ সালের মিয়ানমার নাগরিকত্ব আইন দিয়ে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হয়। তার পরই ১৯৯২ সালে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে সমঝোতা হয়, যেখানে রোহিঙ্গাদের রাখাইনের অধিবাসী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। অথচ ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের যে সমঝোতা হয়েছিল, সে অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের সে দেশের নাগরিক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ফলে মিয়ানমার অনেক হিসাব-নিকাশ করেই ১৯৭৮ সালের ফর্মুলা না এনে, ১৯৯২ সালের ফর্মুলার কথা বলছে।